Tuesday, 12 April 2016

মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর








সূচীপত্র


 বিষয়                            পৃষ্ঠাসংখ্যা
·       ভূমিকা                            ১-৩

·       মন্দির শিল্পের ইতিহাসে                 
 বিষ্ণুপুরের প্রেক্ষাপট                              ৪-৮

·       বিষ্ণুপুরের সামগ্রিক                    
মন্দির শৈলী নিয়ে দু কথা            ৯-১৮

 ·       উৎকৃষ্ট স্থাপত্য                          
   রীতির নির্দশন                      ১৯ -২৫
রাসমঞ্চ ও জোড়বাংলা                       

       ·       মূল্যায়ন                           ২৬-২৮
   ·       গ্রন্থপঞ্জী                              ২৯





কৃতজ্ঞতা স্বীকার

আমি আমার প্রকল্প পত্র ‘মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর’ প্রকল্প পত্র ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সাহায্য পেয়েছি।এই প্রকল্প পত্র সম্পুর্ন করতে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা ড.সৈয়দ তানভীর নাসরিন মহাশয়া ওনার অমূল্য পরামর্শ এবং সতর্ক দৃষ্টিদিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন।ওনার মূল্যবান সাহায্য এবং অকুন্ঠ স্নেহ ভালোবাসা না থাকলে আমি এই প্রকল্প পত্র সম্পুর্ন করতে পারতাম না।এছাড়াও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের কর্মীবৃন্দ,বর্ধমান জেলা গ্রন্থাগারের কর্মীবৃন্দ।এবং বাঁকুড়া জেলা গ্রন্থাগারের কর্মীবৃন্দ বই দিয়ে এবং বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন।বিষ্ণুপুর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কর্মীবৃন্দরাও আমাকে সাহায্য করেছেন।তাই এই প্রকল্প পত্র সম্পুর্ন করার ক্ষেত্রে আমি ওনাদের কাছ থেকে চিরকৃজ্ঞ থাকব। এছারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধুরাও আমাকে এই প্রকল্প পত্র সম্পুর্ন করতে
সাহায্য করেছে বিভিন্ন ভাবে।

                             পাপড়ি ঘোষাল
                             ইতিহাস বিভাগ
            বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়











ভূমিকা

     মূল্যবোধের অন্বেষনে সমাজের যে প্রচেষ্টা তার বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে সংস্কৃতি।তাই যে কোন সমাজের অন্তলোকের পরিচয় পেতে গেলে এই প্রকাশের বিশ্লেষন করতেই হয়।প্রত্যেক স্থানেরই একটি করে নিজস্ব সংস্কৃতি আছে।সংস্কৃতিই হল দেশের প্রাণ,পশ্চিমবাংলারও সংস্কৃতি আছে।বাংলার সংস্কৃতিতে রাঢ় অঞ্চলের সংস্কৃতি একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।এ অঞ্চলের ধর্মানুষ্ঠান,লোকসাহিত্য,জীবনচর্চা সবকিছুরই একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে।এই বৈশিষ্ট্যই হয়ত বঙ্গসংস্কৃতিকে বিশেষ রূপ দিয়েছে।তাই রাঢ়ের সংস্কৃতির মূল্যায়ন বঙ্গসংস্কৃতির মূল্যায়নের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়।
      বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।ভারতের চিরন্তন রূপ বিভিন্ন রূপের মধ্যে অপরিবর্তিত।বিভিন্ন সময়ে শক,হুণ,যবন প্রভৃতি বিদেশী আক্রমণ হলেও ভারতবর্ষ তার নিজস্বরূপ হারিয়ে ফেলেনি।ভারতের পরিপাক শক্তি,বিভিন্ন শক্তিকে আপন করে নিয়েছে।ভারতবর্ষে দেবকল্পনা,দেববিগ্রহ কল্পনা এই গুলিতে অনেক সময় লেগেছে।আনুমানিক খ্রীঃপূঃ চতুর্থ শতকে কৌ্টিল্যের “অর্থশাস্ত্রে” সর্বপ্রথম আমরা “কোষ্ঠ” শব্দটি বাসগৃহ হিসাবেও পাচ্ছি।যেহেতু বৈচিত্র্য ভারতের আর একটি নাম,তাই শিল্প স্থাপত্যেও এর প্রভাব অনিবার্য।
     রাঢ় বাংলাও এর ব্যতিক্রম নয়।‘রাঢ়’ শব্দটি মিলেছে খ্রীঃপূঃ ষষ্ঠ শতকে জৈন্যগ্রন্থ ‘আচারঙ্গ সূত্রে’।একাদশ শতাব্দীর কবি কৃ্ষ্ণ মিশ্র ‘রাঢ়’সম্পর্কে গভীর উচ্ছাস প্রকাশ করেছিলেন।‘রাঢ়’কে গৌড় রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ নগরী বলা হয়।আমি আমার আলোচনার বিষয় হিসাবে এই রাঢ়ের কেন্দ্রে অবস্থিত বাঁকুড়া জেলার মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর কে বেছে নিয়েছি।সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এই অঞ্চলের


মন্দির স্থাপত্য,সঙ্গী্ত,চিত্রকলা,ভাস্কর্য,গণিত,আয়ুর্বেদ,জ্যোতিষ চর্চা এক সময় বাংলা তো বটেই সমগ্র ভারতের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে।বিষ্ণুপর কে বলা যেতে পারে অতীত ভারতের এক অন্যতম কলা নগরী।এই অঞ্চলে মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক সময় বাংলার একান্ত নিজস্ব স্থাপত্য শৈ্লী ও টেরাকোট শিল্পের বিকাশ ঘটে।কালের বিবর্তনে তা আজ অনেকটাই নিতান্তই মূকপাথরের স্তম্ভ হয়ে রয়েগেছে।এই পাথরের জীর্ণ মন্দিরের পিছনে যে বাংলার প্রাচীন গৌ্রবান্বিত সমাজ কাহিনী ও স্থাপত্য উত্কর্ষতা নিদর্শন লুকিয়ে আছে,সেই দিকেই আর একবার আমাদের উত্সাহ ফিরিয়ে আনার জন্যই আমার এই ফিরে দেখা।


প্রথম অধ্যায়
মন্দির শিল্পের ইতিহাসে বিষ্ণুপুরের প্রেক্ষাপট

          
বাঁকুড়া জেলারু নামকরন মনে হয় ধর্মঠাকুর রাজ বীর হাম্বীরের অন্যতম পুএ বীর বাঁকুড়া যে অঞ্চলে রাজত্ব করতেন,সেইখানকার নাম হয় বাঁকুড়া।
       
          আদি অস্ট্রীক আর দ্রাবিড় জাতির মিলন ক্ষেত্র বাঁকুড়া।বর্তমানে ধীবর,ডোম,বাউরী,সাঁওতাল প্রভৃতি জাতির বাস এই অঞ্চলে বেশি।ব্রিটিশ আমলে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের প্রতাপ ক্রমশ কমে আসে।বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা যখন যুদ্ধে যেতেন,তখন তাঁর সেনাবাহিনীর একটা রূপ আমাদের চোখে পড়ে ছড়ার মধ্যে-
 “আগে ডোম,বাগে ডোম,ঘোড়া ডোম সাজে
  ঢাল মেঘর,ঘাঘর বাজে”
       রাঢ়বঙ্গের কেন্দ্রে অবস্থিত বাঁকুড়া জেলার আয়তনে,পশ্চিমবাংলার জেলাগুলির মধ্যে চতুর্থ বৃহতম।সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে জেলাটি একসময় মধ্যবাংলার মধ্যমনি ছিল।বীর হাম্বীর প্রথমে শৈব ছিলেন,পরে অর্থাত্ ষোড়শ শতকের শেষে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহন করেন।তবে বাঁকুড়া জেলা প্রাচীনকাল থেকেই বিষ্ণুর উপাসক;তার প্রমান শুশুনিয়া শিলালিপিতে পাওয়া যায়।যদিও বাঁকুড়া থেকে বাসুদেব,সূর্য, ও ব্রম্ভার মূর্তি পাওয়া যায়,তবে ও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল।পশ্চিমবাংলার রাঢ়ে,যে অঞ্চলে বাঁকুড়া অন্তর্গত আর্যসভ্যতা অনেক পরে এসেছিল।গভীর অরন্যে পরিপূর্ন এই অঞ্চল মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে।বিষ্ণুপুরের মন্দিরে পোড়ামাটিরঁ ছাঁচে ঢালা অশ্বারোহী আর ধনুর্বানধারী মল্ল রাজাদের চিত্র প্রাচীন বাংলার শৌর্য্যময় অতীতের কথা স্মরন করিয়ে দেয়।এই মল্লরাজাদের প্রতাপে স্বয়ং দিল্লীর বাদশাহ পর্য্যন্ত ভীত ছিলেন।বাংলাদেশের সীমান্তে প্রহরীর মত বিষ্ণুপুর রাজ্য পশ্চিমের আক্রমনকারীকে শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকিয়ে রেখেছিল।উড়িষ্যার সংস্কৃতি ও উত্তরবঙ্গে্র উন্নততর আর্যসভ্যতা এই দুটি বিপরীতধর্মী কৃষ্টি ও সংহতির সমন্বয় ক্ষেত্র হল মধ্যবর্তী রাঢ় প্রদেশ,যার প্রানকেন্দ্র হল বাঁকুড়া।
    গঠনশৈ্লির দিক থেকে বাঁকুড়ার মন্দির গুলিকে চারটি মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায় ১)রেখ,২)রত্ন,৩)চাল
৪)দালান মন্দির।খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস,তার পরে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এই ভূভাগের ইতিহাস ও খুবই অস্পষ্ট,খ্রীষ্টিয় আঠারো শতকের প্রায় শেষার্দ্ধে মল্লরাজবংশ একছত্র ভাবে নিজ রাজত্ব শাসন করার সুযোগ পেয়ে বহুবিধ কৃষ্টিমুলক ও জনহিতকর কাজে নিজেদের নিয়োগ করেছিলেন।পাল ও সেন যুগের পরে বাংলাদেশে যা কিছু মহত্ ও বৃহত্ স্থাপত্যকীর্তি রচিত হয়েছে তার অনেকগুলির জন্য মল্লরাজারাই দায়ী। ইটের বদলে ব্যায়বহুল পাথরের ব্যবহার এ রাজবংশ যেম্ন চালু করেছেন।পশ্চিমবঙ্গের আর কোন গোষ্ঠী তেমনটি করেছে কিনা সন্দেহ
          বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তিগুলি নানাবিধ সামাজিক,রাজনৈ্তিক ধর্মীয় প্রভাব ছাড়াও বাংলাদেশের নিজস্ব মন্দির স্থাপত্যশৈ্লী দ্বারা অনেকখানি অনুপ্রানিত হয়েছে।মুসলমানী আমলের আগে ছাদধারনের জন্য মন্দিরগুলির দেওয়াল কিছুদুর পর্য্যন্ত তুলে ধাপে ধাপে শীর্ষ বিন্দুতে মিলিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি বাঁকুড়া তথা ভারতবর্ষের অন্যত্র অনুসৃত হয়েছে।
      ১৮৮২খ্রীঃ “ক্যালকাটা রিভিউ” পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন-বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজাদের দাবী অনুযায়ী তাঁদের রাজবংশের উত্পত্তিকাল দিল্লিতে হিন্দুরাজাদের সমসাময়িক,যখন ভারতবর্ষে মুসলমানদের নামগন্ধ ছিল না।বস্তুতঃ বক্তিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয়ের পূর্বে অন্ততঃ কমপক্ষে পাঁচ শতাব্দী কাল ধরে এ ভূভাগে মল্লরাজবংশ প্রভুত্ব করেছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
         আদিতে দুটি গ্রাম নিয়ে সপ্তম শতাব্দীতে প্রদম্নপুর থেকে শুরু হয় মল্লরাজাদের জয়যাত্রা।৬৯৫খ্রীঃ রাজা রঘুনাথ প্রথম মল্লরাজা হিসাবে সিংহাসনে আরোহন করেন।তখন রাজধানী ছিল প্রদম্নপুর।তাঁর সিংহাসন আরোহনকে স্মরনীয় করার জন্য রাজা রঘুনাথ ৬৯৫খ্রীঃ বাংলার ১০১ সনে মল্লাব্দের প্রচলন করেন এবং তাঁর অধীনের দেশের নাম করেন মল্লভূম।৯৯৪খ্রীঃ রাজা জগত্মল্ল তাঁর রাজধানী নিয়ে যান বিষ্ণুপুরে কারন স্থানটি অনেক বেশী সুরক্ষিত  ছিল।
      ১৫৬৫ থেকে ১৬২০খ্রীঃ পর্যন্ত মল্লরাজ বীর হাম্বীরের সময় বিষ্ণুপুরের প্রকৃত উন্নতি দেখা যায়।এটি ছিল মল্লবংশের স্বর্নযুগ।এই সময় মল্লরাজ বীরহাম্বীর শ্রীনিবাস আচার্য্যের দর্শন পায় এবং তখন থেকেই মল্লরাজত্বের বৈষ্ণব ধর্মের প্রচলন হয়।তিনি ১৬০০খ্রীঃ তৈ্রী করেন বিখ্যাত রাসমঞ্চ।রাজা রঘুনাথের সময় ১৬৫৫খ্রীঃ জোড়বাংলা তৈ্রী হয়।আজ বিষ্ণুপুর একটি প্রাচীন ঐতিহ্যময় শহর।এই শহরের এবং সমগ্র বাঁকুড়া জেলার ঐতিহ্যকে বাঁচানেই আমাদের লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।
      মন্দির নির্মানের পিছনে সম্ভবত তিনটি উৎস ছিল-(১)আকস্মিক আর্থিক সমৃদ্ধি,(২)নবগৃহীত ধর্মের অনুপ্রেরনা ও অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যচেতনা এবং(৩)নৈ্তিকতা বোধ।মুঘল সেনাপতি মানসিংহের সহযোগিতায় মল্লরাজ্যের সীমানা অনেক বাড়িয়ে নিয়েছিলেন হাম্বির।কাছাকাছি ক্ষুদ্র রাজ্য ও সামন্তদের ঐশ্বর্য লুন্ঠিত হয়ে মল্ল রাজকোষে জমা পড়েছিল।আর্থিক সমৃদ্ধি এসেছিল রাজপরিবারে।সুজার শাসনকালে দীর্ঘকালব্যাপী শান্তি ও শৃঙ্খলা বৃহত্তর মল্লরাজ্যের জনজীবনেও সমৃদ্ধির সূচনা করেছিল।মল্লভূমের বাইরে বৃহত্তর বঙ্গ ও ভারতের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যিক যোগাযোগ।রাঢ় ও মল্লভূমের গ্রামীন শিল্পীগোষ্ঠী বৃহত্তর রাজাদের সন্ধান পেয়েছিল।ফলে দক্ষতা ও কারূকার্য উন্নীত হয়েছিল মান।
       নবগৃহীত ধর্ম,সংগৃহীত ধনদৌলত ব্যবহারের দিকটি ইংগিত করেছিল।প্রজার কাছ থেকে সংগৃহীত সম্পদ আবার তাদের কাছেই ফিরিয়ে দেবার রীতি ছিল হিন্দু আমলে।বৈষ্ণব আচার্যের নির্দেশে সম্ভবত সে প্রচেষ্ঠারই উদ্দ্যোগ নিয়েছিলেন মল্লরাজারা।
       আশ্চর্য হলেও লক্ষণীয়,যে রাজারা বড় বড় মন্দির তৈ্রী করে রাজধানী ও রাজ্যের বিভিন্নস্থান সৌন্দর্য মন্ডিত করে তুলে ছিলেন,নিজেদের বসবাসের জন্য কোন প্রকান্ড প্রাসাদ তৈ্রি করাননি।আমোদ-প্রমোদের জন্যও তৈ্রি করান নি বিলাসগৃহ বা প্রমোদকুঞ্জ।নিরাপত্তার জন্য যেটুকু প্রয়োজন ,গড়খাই ও প্রাকারে সেভাবেই সুরক্ষিত করেছিলেন বাসস্থান।নৈ্তিকবোধ ও সৌন্দর্য চেতনার এই যৌথ মিলন বাংলার আর কোথাও দেখা যায় না।                           




দ্বিতীয় আধ্যায়

বিষ্ণুপুরের সামগ্রিক মন্দিরশৈলী নিয়ে দু কথা

        ভারতের ইতিহাসের এক যুগসন্ধি কালে মোগল বঙ্গের এক সমৃদ্ধ শিল্প নগরী বিষ্ণুপুরের প্রেক্ষাপটে,বিকশিত মন্দির ও মন্দির টেরাকোটা শুধু মল্ল রাজত্বের শিল্প সৌকর্যের নিদর্শন মাএ নয়,বাঙালীর শিল্প ইতিহাসের একটি বিশিষ্ট অধ্যায়েরও জীবন্ত সাক্ষী।বাংলাদেশের অন্তিম মধ্যযুগীয় বিকাশের উজ্জ্বল স্মৃতিও বহন করছে এই মন্দির গুলি।আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন (বৃহত্ বঙ্গ দ্বিতীয় খন্ড) “বনবিষ্ণুপুরকে কেন্দ্র করে দুই শতাব্দীকাল বাংলার শিল্পসাহিত্য ও সমাজ নতুন ভাবে গড়িয়া উঠিয়াছিল এবং এদেশের শিক্ষাদিক্ষার যে ঘৃতের প্রদীপটি নিবু নিবু হইয়া জ্বলিতেছিল,বিষ্ণুপুরের রাজবংশ তাহা প্রোজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছিলেন’’।


        
         সত্যিই ৪০০ বছর আগের বিষ্ণুপুরের শিল্পরীতি তুলনারহিত,বিষ্ণুপুর দুর্গের অভ্যন্তরের একাধিক মন্দিরের সমাবেশ লক্ষ্য করে বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গ সংস্কৃতি’ গ্রন্থে একে ‘যাদুঘরের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।তিনি বলেছেন ‘দূর্গের মধ্যে প্রবেশ করলে প্রথমেই মনে হয় যেন বাংলার দেবালয়ের ঐতিহাসিক যাদুঘরে এলাম।দুর্গটি যেন দেবালয় সংরক্ষনের জন্য তৈরী হয়েছিল’।বিষ্ণুপুরের মন্দির স্থাপত্যের দিক থেকে পরীক্ষানিরীক্ষার সূত্রপাত করেছিলেন প্রথম রঘুনাথ সিংহ।
        দেয়ালে টেরাকোটার ফলক সমন্বিত যে মন্দিরটি দিয়ে মন্দির নির্মানের ঐতিহ্য বিষ্ণুপুরে সূচিত হয়েছিল,সেটি ছিল শ্যামরায়ের মন্দির।মন্দিরটি ছিল পরবর্তীকালে ব্যতিক্রম,পরবর্তীকালে নির্মিত অধিকাংশ মন্দির ছিল একরত্ন এটি পঞ্চরত্ন।রঘুনাথ সিংহ মন্দিরটি তৈরী করতে শুরু করলেও শেষ করেননি বা শেষ করলেও প্রতিষ্ঠালিপি সন্নিবিষ্ট করেননি।সেটি করেছিলেন দ্বিতীয় বীর সিঙ্ঘ।বারো বছরো পরে রঘুনাথ মহিষী শিরোমনি অনুরুপ একটি পঞ্চরত্ন মন্দির তৈরী করছিলেন।এই দুটি ছাড়া বিষ্ণুপুর উল্লেখযোগ্য পঞ্চরত্ন মন্দিরের হদিস পাওয়া যায় না।







        রত্নমন্দির আমলে শিখর বা চূড়া সমন্বিত ঢালু বা বাঁকানো ছাদের মাঝখানে যদি একটি চূড়া থাকে,তবে তাকে বলা হয় একরত্ন,পঞ্চরত্ন,নবরত্ন,পঞ্চবিংশতিরত্ন ইত্যদি।বিষ্ণুপুর বাদ দিলে জেলায় পঞ্চরত্নঙ্ক মন্দিরের সংখ্যা বেশী।মল্লরাজাদের পৃষ্টপোষকতায় নির্মিত অধিকাংশ মন্দির ছিল একরত্ন। যা তৈরী হত ল্যাটেরাইট পাথরে।বিষ্ণুপুরে বারোটি একরত্ন মন্দিরের মধ্যে মাএ দুটি,মদনমোহন ও চিন্ময়ী মন্দির তৈরী হয়েছিল ইটে।





        বিষ্ণুপুরের প্রথম একরত্ন মন্দির নির্মান করেন রঘুনাথ সিংহ।সেটি কালাচাঁদের মন্দির।অধিষ্টান লালবাঁধের তীরে।বিষ্ণুপুরের শেষ উল্লেখযোগ্য মন্দির টি ও ছিল একরত্নশৈলীর।রাধাশ্যামের মন্দিরটি তৈরী করেছিলেন চৈতন্য সিংহ।চালা ও বাংলা ধাঁচের মন্দিরের জন্য বিষ্ণুপুর প্রসিদ্ধমন্দিরগুলির গঠন ও চেহারা সাধারণ মানুষের বাসগৃহের মত।কচ্ছপের পিঠের মত বাঁকানো খড়ের চালেরই যেন মাজাঘষা,সংস্কৃতরুপ।বিষ্ণুপুরে চালা ও বাংলা ধাঁচের মন্দির তৈরীর ও সূত্রপাত করেছিলেন প্রথম রঘুনাথ সিংহ।খড়বাংলা পাড়ায় রাধাবিনোদ মন্দিরটি আটচালা।টেরাকোটার অলংকরণে সজ্জিত,বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ট দেবালয় কেষ্টরায়ের মন্দির,জোড়বাংলারীতির।দুটি মন্দিরের নির্মাতা রথনাথ সিংহ।রাজধানী বিষ্ণুপুর ছাড়াও রঘনাথ মল্লরাজ্যের অন্যান স্থানেও মন্দির তৈরী ক রেছিলেন।যথা-যাদবনগর বা বিক্রমপুর।



      অপরুপ টেরাকোটার অলংকরণ ছিল মল্লরাজাদের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্য।বহুলাড়ার সিদ্ধেশর মন্দির টেরাকোটা ক’টি অলংকরণ আছে।সেগুলো যদি মন্দিরটির সমসাময়িক বলে ধরা হয়।দক্ষ টেরাকটা শিল্পীরা মল্লরাজাদের মন্দির তৈ্রীর আগে থেকেই রাঢ় অঞ্চলে বসবাস করতেন বলে অনুমিত হয়।যদিও
মল্লআমলেই তারা প্রাণভরে শিল্পসৃষ্টির সুযোগ পেয়েছিলেন।পোড়ামাটির ফলক দুভাবে তৈরী করা হত।কাঁচামাটির ফলক বা টালিগুলিকে চেঁছেফেলে, কাম্য চিএগুলি প্রথমে তাতে বসিয়ে নেওয়া হত।পরে পোড়ানো হত টালিগুলি।যেখানে চিএগুলি ধরাবাঁধা হত না অথবা শিল্পীর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যের থেকে পৃথক,কাঁচাটালির ওপর চেঁছে কেটে ফুটিয়ে তোলা হত চিএ,পরে পোড়ানো হত।


         মন্দির তৈরীর উদ্দেশ্য শুধু সুন্দরতার আরাধনা ও উপাসনাকেন্দ্রিক ছিল না।লোকশিক্ষার দৃশ্যমান আধারও ছিল তারা।বৈষ্ণব মন্দিরে ভাগবত,পুরাণ ও বৈষ্ণব লোককথার যাবতীয় কাহিনী ও থাকতই,তাদের সাথে রামায়ণ,মহাভারত,দশাবতার ও সমসাময়িক জীবনের টুকিটাকি পরিচয় ও বাদ পড়ত না।কথকতায় ধর্মীয় কাহিনীগুলির যে বিপুল ও বিচিএ উপাখ্যান সাধারণ মানুষের শুনতে অভ্যস্থ ছিলেন।টেরাকোটার চিএে যখন সেসব চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত,স্মৃতির মধ্যে আমৃত্যু নিহিত থাকত তার রেশ।


       বিষ্ণুপুরের রেল স্টেশনের কাছাকাছি দ্বাদশবাড়ি গ্রামের একরত্ন মন্দির এখন ধ্বংস হলেও,তার দোলমঞ্চ চূড়া সোরুসোরু স্তমম্ভের উপর নির্মিত সহজেই লক্ষণীয়।ওন্দা থানার এল্যাটিু বা বেলটুকারি গ্রামের ‘বৌ্দ্ধগয়ার’ সাদৃশ্য আকারৌ বিশিষ্ট দেউলটি ও বিচিএ।বিখ্যাত মন্দির গবেষক ডেভিড ম্যাককাস্টন এটিকে পীড়া দেউলের এক সাম্প্রতিক রুপ বলেছেন।বিষ্ণুপুরের শিল্পরীতি ও মন্দির শৈলীতে ওড়িশীরীতির প্রভাব সুস্পষ্ট।বিষ্ণুপুরের হাজরাপাড়ায় অবস্থিত অধুনাবিলুপ্ত শ্রী শ্রী শ্যামচাঁদের মন্দিরটি ছিল জগমোহন যুক্ত খাঁটি ওড়িশীরীতির ল্যাটেরাইট নির্মিত রেখেদেউল।বিষ্ণুপুর থানার অর্ন্তগত মুনিনগরের শ্রী শ্রী রাধাকান্ত জীউ বিগ্রহের দেউলটি নির্মানরীতি সমাধিক বৈশিষ্ট্যপূণ।মূলমন্দিরটির সামনে এক হ্রস্বতর দেউল নির্মান করে(অন্তরাল সৃষ্টি করে)জগমোহন রচনার বিচিএ কৌশলটি মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেএে অভিনবত্বের পরিচায়ক।বিষ্ণুপুর শহরের মহাপাএ পাড়ার শ্রী শ্রী মুরলীমোহনের মন্দিরটি গঠনবৈচিএে আকর্ষণীয়।মূল মন্দিরের(একরত্ন)চারিদিকে এখানেও বারান্দাযুক্ত করা হয়েছে।বিভিন্ন স্থাপত্যরীতির অবিরাম পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে যেন মল্লভূমে।


         মল্লভূমের অধিষ্ঠাএী সর্বজনপূজ্যা দেবী শ্রী শ্রী মৃন্ময়ী মন্দিরের দক্ষিণদিকের একজোড়া দীর্ঘাকৃতি রেখদেউল এবং বড় বড় পাথর দরজার(দুটি দূগাদ্বারের মধ্যের বৃহত্তর দূগাদ্বারটির)অদূরে শ্যামকুন্ডু পুষ্করিণীর তীরে একজোড়া ইঁটের দেউল।গঠন বৈচ্যিএে সমুজ়্বল।এই দুটি মন্দিরের সর্বাঙ্গ এককালে টেরাকোটা চিএে আচ্ছাদিত ছিল।অধিকাংশ টালিতেই  ছিল ‘গজসিংহ’ মেটিফ।যেখানে ওড়িশী প্রভাব সুস্পষ্ট।


     মন্দির তৈরীর ক্ষেএে শিখর মন্দিরের উপরেই মল্লরাজাদের সমাধিক পক্ষপাতিত্ব ছিল।ধনুকাকৃ্তি চালাঘরের অনুসরনে নির্মিত ছাদের উপর এক বা একাধিক চূড়াবসিয়ে ‘রত্নমন্দির’ নির্মানের ই প্রবণতাজাত।এই চূড়াগুলি ও প্রকারান্তের রেখ আর পীঢ়া দেউলের সমন্বয়ে রচিত অনুবর্তন।শিখর মন্দির মত্স্যপুরা্ণানুমোদিত।


    শ্রী শ্রী মদোনমোহন মন্দিরের টেরাকোটা চিএের সংখ্যাস্বল্প।কিন্তু বিন্যাস চারুতায় বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।এখানে মহাভারতের যুদ্ধ ওকৃ্ষ্ণের জন্মকথা চিহ্নিত হয়েছে।এখানের মন্দিরে হংসলতা প্যানেলটি সমাধিক আকর্ষণীয়।শ্রীমদনমোহন মন্দিরের সামনে এিখিলান প্রবেশদ্বারের বাঁদিকে প্রায় ভিত্তিহীন সংলগ্ন
পাটিতে একটি গোস্বামী চিএ(টেরাকোটা চিএ)আছে।চিএটিতে পুঁথিপাঠরত এক গোস্বামীর পাশে এক রাজপুরুষ পাঠ শুনছেন।এটিকে মল্লরাজসভার বিজয়ের ঐতিহাসিক চিহ্ন মনে করা অসংগত নয়।

    যাই হোক বিষ্ণুপুরের মন্দির গুলিতে টেরাকোটা অলংকরণ শুধু সুন্দুরতার জন্য নয়,গুরুত্বপূণ ও বটে।শ্রীমদ্ভভগবতের দশম অধ্যায়ে বর্ণিত কৃষ্ণলীলা এখানের মন্দির টেরাকোটার প্রধান উপজীব্য।শ্রী শ্রী শ্যামরায়,শ্রী শ্রী মদনমহনে যথাক্রমে রাসলীলা,বৃন্দাবনলীলা ও কৃষ্ণজন্মের অসামান্য বস্তু মন্দির টেরাকোটা রুপলাভ করেছেসাধারণ মানুষের মধ্যে নৈতিকবোধের যে ধারণাগুলি ইংরেজ আমলের আগে অবধি বজায় ছিল টেরাকোটা চিএ।কথকতা,কীর্তন,রামায়ণ ও মহাভারত পাঠছিল তাদের প্রধান রসদ।মল্লরাজারা সম্ভবত এ সত্য বুঝেছিলেন পারিপার্শ্বিক প্রয়োজনেঅরণ্য অধ্যুষিত মল্লরাজ্যে জনজীবনের প্রকৃতি ছিল নিষ্ঠুর।প্রকৃতিক প্রয়োজনেই সে নিষ্ঠুরতা সহজাত হয়ে উঠেছিল।নবগৃহীত ধর্ম যেহেতু নিষ্ঠুরতার স্থান ছিল নিন্দনীয়।জনসাধারণকে নতুন ভাবে শিক্ষিত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।অজস্ব্র টেরাকোটার উদ্ভব ছিল একটি দিক।ফলে টেরাকোটায় দৈনন্দিন জীবনের চিএ স্থান পেয়েছে কম।যে বিষয় গুলি অত্যন্ত পরিচিত যেমন-চাষাবাদ,মাছধরা, এসব একেবারেই অনুপস্থিতি।পরের দিকে অবশ্য অভিজাত সমাজের বিলাসব্যসনের বহু চিএ দেখা যায়।

   বিষ্ণুপুরের উল্লেখযোগ্য মন্দির গুলি তিরিশের নিচে হবে না।দেউল পর্বের অন্যতম প্রধান মন্দির হল-মল্লেশ্বর শিব,১৬৪২খ্রীঃ রুঘুনাথ সিংহ এটি তৈরী করেন।রত্নমন্দির বিষ্ণুপুর জেলায় বিশেষ সমাদৃত ছিল।ইট ও মাকড়া পাথরের তৈরী কালাচাঁদ মন্দিরের গায়ে পৌরাণিক দেবদেবী,কৃষ্ণলীলা প্রভৃ্তি দৃশ্যের অবতারণা করা হেয়েছে।অষ্টকোণাকৃ্তি নবরত্নবিশিষ্ট মন্দিরের চূড়ায় পদ্ম,আমলক,ঘট ও ধ্বজা।১৫৬৫খ্রীঃ মন্দির টি নির্মিত হয়েছিল।১৭৩৭খ্রীঃ নির্মিত রাধামাধব মন্দিরভিত্তিবেদীর সমান্তরাল দুটি সারিতে পশুপক্ষীর টেরাকোটা দেখা যায়।খিলানশীর্ষ ও থামেরা গায়েও নানাবিধ সজ্জার ছড়াছড়ি।বিষয়-প্রধানত কৃষ্ণলীলা,দশাবতার পদ্ম প্রভৃতি।বর্তমান মদনমহন মূর্তি চুরি যাওয়ায় রাধাকৃষ্ণেনর মূতি উপাসিত হচ্ছে।কালাচাঁদের অনুসৃ্ত এই মন্দিরে পোড়ামাটির বিন্যাস। একদিকে পশুপক্ষী,কৃষ্ণলীলা,দশাবতার ও অন্যান পৌরাণিক কাহিনী রুপায়িত,অপরদিকে স্থান পেয়েছে প্রধানতঃ যুদ্ধদৃশ্য।থামের গায়ে কীর্তন ও খিলানশীর্ষে কুরুক্ষেএ যুদ্ধ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী।



      ১০৬৪ মল্লাব্দে মল্লরাজা চৈতন্য সিংহ কতৃক রাধাশ্যাম জীউর মন্দির নির্মিত হয়।মন্দির টি মাকড়া পাথরের এবং চারচালা রীতিতে গঠিত।গম্বুজাকৃতি রত্নশিখর টি বৈশিষ্ট্যপূর্ন।দক্ষিণমুখী দেওয়ালে অনন্তশয্যায় শায়িত বিষ্ণু,ব্রক্ষ্মা,মহেশ্বর ও গণেশাদি দেবতা,হাতি,ঘোড়া,মহিষ ও হরিণ ইত্যাদি পশুপাখি,নরনারী,প্রভৃতি পোড়ামাটির মূর্তিদ্বারা সুন্দর ভাবে অলংকৃত।যাহারজোড় গ্রামে মহামায়া মন্দিরটিও অতি প্রাচীন।মূল মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও বাংলা ১৩১২ সনে পুননির্মিত হয়।মাকড়া পাথরের তৈরি এই মন্দিরটি চারচালা ধরণের।মন্দিরের অভ্যন্তরে দেবী মহামায়া আসীনা।চারহাতে চারটি আয়ূধ।মহামায়ার মন্দিরে এক দুর্বোধ্য শিলালিপি আছে যারা পাঠোদ্বার আজও সম্ভব হয়নি।


  শ্যামরায় মন্দিরে ছোটবড় চল্লিশটির মতো রাসচক্র দিয়ে মন্দিরটির তাত্ত্বিক শ্রেণীকরণ করা হয়েছে যেন।প্রেম ভক্তির প্রেক্ষাপটে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের সর্বোওম রস মধুর রসের অভিব্যাক্তি ঘটেছে এখানের টেরাকোটায়।


রাসমন্ডল ছাড়াও শ্যামরায়ের মন্দিরের পূর্বদিকে প্রাপ্ত গোপীস্কন্ধে ন্যস্ত
বাহুভার নৃত্যরত শ্রীকৃষ্ণের চিএগুলি শ্রীমদ্ভাগবতের এক শ্লোকেরই যেন চিএরুপ।কৃষ্ণকেমুখী করেই পরিতৃপ্ত গোপীরা,মন্দিরের শতাধিক শ্রীকৃষ্ণ  সমভিব্যহারের নৃত্যরত শতাধিক গোপীচিএ যেন তারই অভিব্যক্তি।



       শ্যামরায়ের মন্দিরে যাবতীয় খিলান,ভল্ট,গম্বুজের তলদেশ যে ভাবে অলংকরণে ঢেকে দেওয়া হয়েছে সারা পশ্চিমবঙ্গ এ তার কোন তুলনা নেই।দেওয়ালে কৃষ্ণলীলা অগ্রাধিকার পেলেও,সামাজিক,পৌরাণিক,রামায়ণ,মহাভারত থেকে আহৃত দৃশ্যাবলী,শক্তি বা শিব উপাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত,জ্যামিতিক নক্সা ও ফুলকারি কাজের অজস্ব্র ব্যবহৃত হয়েছে।গুপ্তযুগের ‘গজেন্দ্রমোক্ষ’ ক্লাসিক চিএটির মাধ্যমে শরণাগত ভাবটি পরিস্ফুট হয়েছে শ্যামরায়ের মন্দিরে,পশ্চিমের বারান্দায় ‘গজকচ্ছপের যুদ্ধচিএ’ একই ব্যঞ্জনা।সখ্য-দাস্য রীতির প্রকাশেও লক্ষ্য করা যায়এখানের টেরাকোটায়পৌরাণিক সমন্বয়ে সমৃদ্ধ বাতাবরণ লক্ষ্য করা যায় এখানেপশ্চিমের বারান্দায় ভগবান বিষ্ণুর দশাবতার প্যানেলের পাশাপাশি মহাদেবীর দশমহাবিদ্যা প্যানেল।কেন্দ্রীয় চূড়ায় হরিহরের টেরাকোটা চিএটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্যযোগ্য।গর্ভগৃহ প্রবেশের দক্ষিণ বারান্দা থেকে গলি পথটির ডানদিকে নানা সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুদের একএে চিএ ‘সর্বধর্মসমন্বয়ের’ ইঈিত।শ্রীমদ্ভভাগবতের পরিজাত হরণ চিএটি দেখা যায় এই মন্দিরের দক্ষিণ বারান্দায়।গোস্বামী গ্রন্থের একাধিক শোল্ক টেরাকোটায় মূর্ত হয়েছে।শ্যামরায়ের মন্দিরের টেরাকোটায় ‘মঞ্জরী ভাবসাধনার’ ইঈিত দুর্নিরীক্ষ্য নয়।শ্যামরায়ের মন্দিরের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে(এিখিলান প্রবেশদ্বারের দুপাশে) কুঞ্জকুটিরে লীলারতি রাধাকৃষ্ণের মূতির সম্মুখে করজোড়ে দন্ডায়মান ভক্তের মূতিগুলি মঞ্জরী সাধনার ইঙ্গিত  বহন করে বলেই মনে হয়।পূর্বদিকের এিখিলান প্রবেশদ্বারের মাথায় ‘রামায়ণের যুদ্ধ’ চিএটিও চিত্তাকর্ষক।যুদ্ধরত রামরাবণের মূতির পাশে করজোড়ে দন্ডায়মান হনুমানের চিএ টিও ভক্তিবাদক। সবারাকোন গ্রামে মাকড়া পাথর নির্মিত জঙ্গারাম কৃষ্ণজীউর নামে প্রসিদ্ধ ।মন্দিরের চারিদিকে ইটের প্রাচির।মন্দির টি দক্ষিনমূখী এবং আটচালা প্রকৃতির।শিলালিপি থেকে জানা যায় যে ৯৪৩ মল্লাব্দে বিষ্ণুপুর রাজ বীরসিংহ কর্তৃক এই মন্দির নির্মিত।মন্দিরের চূড়ায় শতদল পদ্ম,আমলক,কলসে ধ্বজা প্রতিষ্ঠিত।


      মল্লরাজাদের কীর্ত্তিরাজির মধ্যেও ব্রাম্ভন্য সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের প্রয়াসের আভাসও সুস্পষ্ঠ।অতএব এক তপর্যপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বির্তনের প্রেক্ষাপটেই মল্লভূমির মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সূচনা হয়েছিল।
তৃতীয় অধ্যায়

রাসমঞ্চ

বাঁকুড়া তথা মধ্যরাঢ়ের ইতিহাস মল্লরাজ বংশের ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। পায় পাঁচ শতাধীক বছর আঠারো খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় স্বাধীন মল্লরাজ শাসিত বাঁকুড়া তথামল্লভূমকৃষ্টি ও সংস্কৃতির চরম বিকাশ বা রেঁনেসার সূচিত হয়। যা বাংলার অন্য কোন প্রান্তে তখনও অনুষ্ঠিত হয়নি।সেই মল্লরাজাদের রাজধানী ‘বিষ্ণুপুর’,-- যাকে শ্রী রামকৃষ্ণদেব ভালোবেসে বলেছেন ‘গুপ্তবৃন্দাবন’।বিষ্ণুপুরকে কেন্দ্র করে ধর্ম,সাহিত্য,সঙ্গীত,স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে উতকর্স্মুখী যে জোয়ার শুরু হয় তা সমগ্র মধ্য রাঢ়কে প্লাবিত করে।  বাঁকুড়ার মন্দির স্থাপত্য বহিরাগত কৃতকৌশলে যে পরিপুষ্ট লাভ করেছিল তা বিষ্ণুপুরের কোন না কোন মন্দিরে পরিলক্ষিত হবে।কারন এখানের শিল্পীরা যখনই কোন স্থাপত্য রীতি শিখেছে তখনই তারা মল্লরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুরে সেই পদ্ধতির মন্দির নির্মাণ করার বা বলা যেতে পারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছে।তাই এখানের মন্দির সমূহকে দেউল,চাল ও রত্ন স্থাপত্যগত দিক দিয়ে এয় তিনশ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে ।

   এই তিন স্থাপত্য কৌশলের বাইরেও কিছু মন্দির রয়েছে ,তার মধ্যে যোড়ষ খ্রীস্টাব্দে বীরহাম্বির নির্মিত রাসমঞ্চটি অন্যতম।পাঁচ ফুট উঁচু আশিবর্গফুট আয়তনের দেশি ঝামা পাথরের আসনের উপর ইটের তৈরি পঁয়ত্রিশফুট উঁচু প্রধান মন্দির গর্ভগৃহ ও তার দক্ষিণে ছোটকক্ষটিকে ঘিরে তিন প্রস্থ খিলান যুক্ত দেওয়াল চারিদিকে বেস্টন করে আছে।একেবারে ভিতরের দেওয়ালের প্রতিদিকে পাঁচটি,দ্বিতীয় দেওয়ালের প্রতিদিকে আটটি এবং বাইরের দেওয়ালের প্রতিদিকে আটটি এবং বাইরের দেওয়ালের  ফুলকাটা  প্রশস্ত খিলান বড় আটকোনা  স্তম্ভের ওপর সংস্থাপিত।চারিদিক থেকে ধাপে ধাপে চাল ছাদে গিয়ে মিলিত হয়েছে।পিরামিডের মতো করে প্রধান লক্ষ্য করে প্রতিদিকে চারটি করে এবং প্রতিকোণে একটি করে চারচাল সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নির্মিত হয়েছিল।বর্ত্মানে অবশ্য এগুলি ধ্বংস হয়ে পড়েছে।মল্লরাজাদের রাজত্বকালে রাসে সময় বিষ্ণুপুরের সব দেব বিগ্রহ এখানে রাখা হতো জনসাধারনের দ্ররশ্নের জন্য।

বিষ্ণুপুরের অধিকাংশ বিখ্যাত মন্দির শাহাজানের সমকালীন হলেও, অনেকে মনে করেন ‘রাসমঞ্চ’ ১৬০০ -১৬১০ খ্রীস্টাব্দে মল্লরাজা বীরহাম্বীরের দ্বারা নির্মিত,যদিও আজ পর্যন্ত এবিষ্যে কোন নিবেদন লিপির সন্ধান পাওয়া যায়নি। ডেভি্ড ম্যক্কাচ্চনের মতে ১৬৬০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি সৌধটি নির্মিত হয়েছে।তার বর্ণনায় এক বিশিষ্ঠ স্থাপত্য রীতির কিছুটা পরিচয় মেলে।বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। বিষ্ণুপুর  শাখার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড.মানিকলাল সিংহ মনে করেন এখানে রাস উতসব উপলক্ষে যাত্রাভিনয় হতো।


        রাসমঞ্চ সম্পর্কে ড.মানিকলাল সিংহ লিখেছেন –“পিরামিড আকৃতি চূড়ামূলক চারিদিকে বেস্টন করিয়া৫১/৫২ ধাপ সিঁড়ির শেষ পর্যায়ে প্রতিটি কোনায় একটি করিয়া চারটি চারচালা নীচের প্রকোষ্ঠ গুলির দুটি পার্শ্বের স্তম্ভ গুলি আচ্ছাদন খিলানের উপরে প্রতিদিকে চারটি করে দোচালা আকারের ইমারত।দূর হইতে দেখিলে মনে হয় যেন একটি পাহারের কোলে একটি বাংলা গ্রাম গরিয়া উঠিয়াছে।মূল সৌধকে বেস্টন করিয়াবেদীটি চারিদিকে সমান প্রশস্ত।রাসমঞ্চের দক্ষিণে প্রশস্ত সমতল ভূমি,পুর্বপার্শ্বে অপেক্ষাকৃত কম প্রশস্ত ভূমি।সমস্ত মিলাইয়া দেখিলে মনে হয় রাসমঞ্চ এর ৫ ফুট উঁচু বেদীতে রাস যাত্রাভিনয় হইত।আর দক্ষিণে ও পুর্বের সমতল জায়গায় বসিয়া দর্শকগণ যাত্রাভিনয় দর্শণ করিত।”রাজা বৈজলের আঞ্জায় জগম্মোহন পন্ডিত ‘ষটপঞ্চাশৎ দেশাবলী’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই পুঁথি থেকেও ৩০০ বছর আগের বঙ্গদেশের কিছু বিবরন পাওয়া যায়,যদিও তা সবক্ষেত্রে নির্ভুল নয়। এই পুথি থেকে বিষ্ণুপুর সম্পর্কে যে বিবরন পাওয়া যায় তাতেও রাসমঞ্চের উল্লেখ আছে।
                 রাসমঞ্চে যে কয়েকটা টেরাকোটার ফলক দেখা যায় তা সবই নাচের,রাসমঞ্চে অনুষ্ঠিত রাসপর্ব বা রাসযাত্রাভিনয় বর্তমানে কল্পনার বস্তু হলেও রাসলীলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের সাক্ষ দিচ্ছে শ্যম্রায় মন্দিরের শতশত টেরাকোটার চিত্র,বিশেষত ৪০/৪২ তি রাসমন্ডল।জগন্মোহন পন্ডিত তাঁর রচনায় আরো বলেছেন কার্ত্তিক পৌর্ণমাসীতে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা হতো এখানে।পর্বতাকার রাসমঞ্চ তিন শত দ্বারসংযুক্ত (যদিও আসল দ্বার একশ্ত এর কিছু বেশী)
রাসমঞ্চ সত্যিই বিষ্ণুপুরের এক অন্যতম কলা বলা যেতে পারে।এক সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তির নিদর্শন।এর সৌন্দর্য সত্যিই অবর্ণণীয়।  
 (বিঃদ্রঃ- মল্লভূমের প্রথম রাসযাত্রাভিনয়ঃমানিক্লাল সিংহঃ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিষ্ণুপুর নিখিলবঙ্গ  শিক্ষ্ণ মহাবিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত under graduate faculty improvement  teacher  education seminar উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক পত্রিকা,১৯৭৮ )

জোড়-বাংলা

জোড়-বাংলা রীতির মন্দির স্থাপত্য এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় বেশ কিছু থাকলেও বিষ্ণুপুরের জোড়বাংলা আপন স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ঠে  সমুজ্জ্বল।জোড়বাংলা ম্পন্দিরে যে ‘বাংলার ঘরের চাল’এর আদল  তা সমগ্র বঙ্গে প্রচলিত ।জোড়বাংলা মন্দিরে প্রাপ্ত লিপি অনুসারীই মন্দিরটি ৯৬১ মল্লাব্দে(১৬৫৫ খ্রীস্টাব্দ) মল্ল রাজ রঘুনাথ সিংহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।দু’খানি দুচালা ‘বাংলার কুটির ঘর পাশাপাশি জুড়ে দিলে যা হয় তাই জোড়বাংলা’বাংলার মন্দির নির্মানের অপূর্ব নিদর্শন এই ‘জোড়বাংলা’মাটি ইট দিয়ে এর দেওয়াল তৈরী হয়েছে। ভিতরে ও বাইরে মাটির দেওয়ালের উপ ভার্স্কয্য খচিত চিত্র দিয়ে সুসজ্জিত।জোড়বাংলা মন্দিরের গঠন শৈলী বর্ণনা করে “Archaeological survey of India” রায় দিয়েছে যে এই মন্দির টি “কেষ্টরায়”মন্দির নামেও পরিচিত। দক্ষিণ মুখী মন্দির টি বর্গাকার ভিতের উপর গড়ে উঠেছে।দুটি ‘দো-চালা’ যুক্ত হয়ে চারচালা শিখরের রূপ নিয়েছে।


জোড়-বাংলা মন্দির টি বহিঃ ও অভ্যন্তর দেওয়ালের সূক্ষ্য এবং অলংকৃত টেরাকোটার কাজ লক্ষ করা যায়।এই মকন্দির টির ভেতরের দৈর্ঘ ১১.৮ মিটার,প্রস্থ ১১.৭ মিটার এবং গঠনগত উচ্চতা ১০.৭ মিটার।এই মন্দিরটির সম্মুখ দ্বার এর চারপাশের তিনটি দেওয়াল চমৎকার টেরাকোটার কাজ দ্বারা সুসজ্জিত।শুধুমাত্র ছয় হাত যুক্ত শ্রী চৈত্যনের প্লাস্টার করা চিত্র এই মন্দিরের ভিতরে পাওয়ে যায়,যদিও তিনি পুজ্য নন।

বিষ্ণুপুরের জোড়-বাংলা মন্দিরের পশ্চিম দেওয়ালে ভীষ্মের শরশয্যা ও বানক্ষেপনরত অর্জুনের অতি উৎকৃষ্ট একটি ভাস্কর্য নিবন্ধ
আছে। অর্জুনের লক্ষ্যভেদ প্রভৃতি চির পরিচিত মেটিফ গূলির প্রচূর ব্যবহার হয়েছে।জোড়-বাংলা
মন্দিরে যুদ্ধক্ষেত্রের যে অগনিত ভাস্কর্য সন্নিবিষ্ট হয়েছে সেগুলি সম্ভবত মল্লরাজাদের শৌর্যের পরিচায়ক নয়।কেননা প্রায় সর্বত্রয় চতুরঙ্গ বাহিনীর যে খন্ডচিত্র গুলি উৎকীর্ন হয়েছে তার আকার প্রকার দেখে মনে হয় – সেগুলি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের খন্ড বিচ্ছিন্ন চিত্র কল্প।প্রসঙ্গত বিষ্ণুপুরের জোড়-বাংলা মন্দিরে ও অন্য বহু ক্ষেত্রে যে চিত্রন দেখা যায় সেগুলি মল্ল- ক্ষাত্র বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা সন্দেহ।মল্লরাজগ্ণ নৌবলে বলীয়ান কিলেন এমন কোন প্রমান নেই।এগুলি সম্ভবত অতীত কালের বাঙ্গালীর নৌ যুদ্ধে নিপুনতার পরিচায়ক।মল্লরাজা যে নিপুন যোদ্ধা ছিলেন এবং এ বিষ্যে নিয়মিত যগ দিতেন সে বিষ্যে সন্দেহ নেই।জোড়-বাংলা মন্দিরে সে জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় শিকারের চিত্রও সন্নিবিষ্ট হয়েছে।শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্দে বর্ণিত কৃষ্ণলীলা এখানে মন্দির টেরাকোটার মূল উপজীব্য।

জোড়-বাংলা মন্দিরে  শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলা অসুর বধ থেকে মথুরা যাত্রা,কংস বধ চিত্রিত হয়েছে।জোড়-বাংলা মন্দিরের দক্ষিণ দিকে কৃষ্ণলীলা আর তারই সমান্তরালে পশ্চীমের দেওয়ালে রামকথা।রাম জন্ম থেকে আরম্ভ করে তারকা বধ এবং রামের বিবাহ।এই মন্দিরে বাৎসল্য রসের অভিব্যক্তি লক্ষ্য মকরা যায়।একই ভাবে রামকথা আর কৃষ্ণকথা ব্যক্ত হয়েছে একই রস পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করে।বাৎসল্য রসের অভিব্যক্তি পরিস্ফুট করার জন্যে ,মাতৃক্রোড়ে রাম-লক্ষণ-ভরত-শত্রুঘ্নকে যেমন (পশ্চীম দেওয়ালে)চিত্রিত করা হয়েছে,দক্ষিণের(অগ্রবর্তী দো’চালায়) প্রবেশ পথের ডানদিকে মাতৃক্রোড়ে কৃষ্ণ বলরামও উৎকীর্ণ হয়েছেন।এমনকি পশ্চীমের দেওয়ালে ভয়ঙ্কর দেবীযুদ্ধের নীচে গনেশ জননী,স্কন্দমাতার,বাৎসল্যরসাত্মক চিত্র গুলি সন্নিবেশিত হয়েছে।অষ্টমাতৃকা মূর্তিও চিত্রিত হয়েছে।এখানে সমসাময়িক ঘটনা রূপে পর্তুগীজ যুদ্ধ যেমন চিত্রিত হয়েছে,মোঘল সামন্তদের আভিজাত্য ও বিলাস ব্যসনও তেমনি চিত্রিত হয়েছে।


মূল্যায়ন

 সপ্তদশ শতকের বিষ্ণুপুরে যে অভিনব শিল্প বিকাশ ঘটেছিল তা শুধু বিষ্ণুপুর বাঁকুড়া নয় বঙ্গের শ্লাঘার বস্তু।‘গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে’ বীর হাম্বারের দীক্ষা গ্রহন শুধু মল্লভূমের নয়,বাংলার,সংস্কৃতির ইতিহাসে যুগান্তর এনেছিল।এখানের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে যেমন ওড়িশার প্রভাব অনুভূত হয়,তেমনি মল্লভূমের তত্কালীন চর্চা চিন্তা,শিক্ষাদীক্ষায় নবদ্বীপের প্রভাবও সুস্পষ্ট ভাবে লক্ষ্যনীয়।
      অন্তিম মধ্যযুগের বিষ্ণুপুর তথা বঙ্গের মন্দির স্থাপত্যে হিন্দু মুসলিম শিল্পরীতির স্বচ্ছন্দ মিলন ঘটেছে,কোথাও রক্ষনশীলতা বা সীমাবদ্ধতার প্রকাশ নেই।বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা মন্দির নির্মান ও স্থাপত্য ভাস্কর্যে বহু অর্থ ব্যয় করে দৃষ্টিনন্দন ও শিল্প উত্কর্ষ ভাস্কর্য গড়ে তুললেও তাদের বাসস্থান ও রাজপ্রাসাদ নির্মানে বিপুল অর্থব্যয় করেছে বলে এমন প্রমান নেই।মল্লরাজাদের মন্দির তৈ্রির উদ্দেশ্য শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টি বা উপাসনা কেন্দ্র ছিল না,লোকশিক্ষার দৃশ্যমান আধারও ছিল।
   ভাগবত,পুরাণ ও বৈষ্ণব লোককথার যাবতীয় কাহিনীতে থাকতই,তার সঙ্গে রামায়ন,মহাভারত,দশাবতার ও সমসাময়িক জীবনের টুকিটাকি পরিচয়ও বাদ পড়ত না।কথকথায় ধর্মীয় কাহিনীগুলির যে বিপুল ও বিচিত্র উপ্যাখান সাধারন মানুষেরা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন টেরাকোটার চিত্রে তা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত।মল্লরাজ্যে নবগৃহীত ধন সেহেতু নিষ্ঠুরতার কোন স্থান ছিল নিন্দনীয়,ফলে নতুনভাবে জনগন কে শিক্ষিত করার প্রয়োজন ছিল।তাই অজস্র টেরাকোটময় যার প্রকাশ হয়।
       টেরাকোটায় অত্যন্ত পরিচিত ও দৈনন্দিন জীবনের চিত্র স্থান পেয়েছে কম।যেমন-চাষাবাদ,মাছধরা এসব একেবারেই অনুপস্থিত।মল্লরাজাদের সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুপুরের কদর কমেছে।যে বিষ্ণুপুর তখন গুপ্ত বৃন্দাবন নামে খ্যাত ছিল,যেখানে সুন্দর সুন্দর মন্দিরাদি শোভা পেত,তা আজকালের প্রভাবে,অযত্নে,অনাদরে ক্ষত বিক্ষত,জীর্ণ পোড়ামাটির অলংকরনে অলংকৃত এই সমস্ত মন্দির অধিকাংশই বিগ্রহ হীন।ভারতের কোন কোন প্রান্তে ‘মিথুন ভাস্কর্য’যে রূপ স্ফুর্তিলাভ করেছিল তাঙ্গ সৌভাগ্যের বিষয়,রাঢ়দেশে টেরাকোটার অলংকরনের ক্ষেত্রে সেরকম ঘটেনি।মন্দিরে পাথরের ব্যবহার এ রাজবংশ যতটা করতে পেরেছেন,পশ্চমবঙ্গে আর কোন গোষ্ঠী তেমনটি করেছেন কিনা সন্দেহ।গবেষকরা মনে করেন একসময় মল্লভূম বঙ্গের অন্যতম বিশিষ্ট্য এক চর্চাকেন্দ্রে পরিনত হয়।ন্যায় এবং স্মৃতির প্রচুর চর্চা হয়েছিল এখানে।নব্যন্যায় ও নব্যস্মৃতির চর্চার ধারা নবদ্বীপ  থেকে এখানে প্রবাহিত হয়।
      মাত্র দুশতকে অথবা তারও কম সময়ে মল্লভুম তথা বিষ্ণুপুরের এই সর্বাত্মক বিকাশ বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।বিনয় ঘোষের ভাষায় তাই বলাই যায়-যিনি বিষ্ণুপুরের দেবালয় দেখেননি,তিনি বাঙালি হয়েও বাংলার অমরাবতী দর্শন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।







গ্রন্থপঞ্জী

·       বন্দোপাধ্যায় অমিয়কুমার –“বাঁকুড়ার মন্দির”,সাহিত্য সংসদ
·       দাশগুপ্ত চিত্তরঞ্জন –“ভারতের শিল্প সংস্কৃতির পটভূমিকায় বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা”
·       রায়চৌধুরী প্রমিত-“বঙ্গ সংস্কৃতির কথা”
·       পাল প্রতাপাদিত্য-“ আর্ট এন্ড আর্কিটেকচার অব বিষ্ণুপুর” 
·       ঘোষ বিনয় –“পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি” ‘প্রথম খন্ড কলকাতা,প্রথম খন্ড’
·       ডঃ রায় রামরঞ্জন-“পশ্চিমবঙ্গের দেবদেউল পুরাকীর্তি ও লোক সংস্কৃতি”
·       ভট্টাচার্য তরুনদেব –“পশ্চিমবঙ্গ দর্শন বাঁকুড়া,কলিকাতা ১৯৮২”
·       ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বাঁকুড়া জেলা সংখ্যা, ১৪০৯


 remembering my friend great work "MANDIR NAGORI BISHNUPUR"
A LOTS OF LOVE THE LATE Ms.PAPRI GHOSAL

.....................................................edited by nilay dutta
     












3 comments:

  1. এটার কি কোন PDF Version পাওয়া যাবে?

    ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. বিষ্ণুপুরের রাজারা তত্পার্শ্ববর্ত্তি অঞ্চলে যে সমস্ত মন্দির নির্মাণ করাইয়াছিলেন তার কোনো উল্লেখ পেলাম না।

    ReplyDelete
  3. হুগলী জেলার মন্দির নিয়ে কোনো idea paoajabe

    ReplyDelete